নাবিলের বাবা একজন চাকরিজীবী। মাসের শেষে বেতন পান ২০,০০০ টাকা। তিনি পারিবারিক ব্যয়ের জন্য কিছু টাকা নগদ রাখেন এবং কিছু টাকা ব্যাংকে আমানত রাখেন। কিছুদিন পর তিনি ঠিক করলেন মুরগির খামার দেবেন। এজন্য তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন। ব্যাংক তাকে ১০% সুদে ৩৬ মাসে পরিশোধ করার শর্তে এই ঋণ প্রদান করে। তাঁর আয়-ব্যয়, সঞ্চয় ও ঋণ সবই অর্থের মাধ্যমে হয়ে থাকে । অর্থ ও ঋণের ব্যবসা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ব্যাংক জনগণের উদ্বৃত্ত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে ঋণগ্রহীতাকে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। আমাদের দেশের কৃষি উন্নয়ন, শিল্পায়ন, আত্মকর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
রহমত আলী গরিব কৃষক। তার ৫ কাঠা জমি আছে যাতে সে ধান ফলায়। টাকার অভাবে সে উন্নত মানের বীজ, সার কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারে না। পরবর্তীতে সে একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উন্নতমানের বীজ এবং প্রয়োজনমত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে । ফলে তার জমিতে অধিক ফসল হয়।
সেলিম সাহেব একজন শিল্পপতি। তিনি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চান। এজন্য তিনি অন্য একটি ব্যাংকের কাছে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন।
রহিম একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরি করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে এ ব্যাংক আমানত হিসেবে গ্রহণ করে। ব্যাংক সঞ্জিত অর্থ ব্যবসায় ও উৎপাদন ক্ষেত্রে ঋণ দিয়ে পুঁজি গঠনে সহায়তা করে।
দীর্ঘকাল যাবৎ কৃষক তার ধানের বিনিময়ে তাঁতির কাছ থেকে কাপড় এবং জেলে তার মাছের বিনিময়ে কুমারের কাছ থেকে হাঁড়ি-পাতিল সংগ্রহ করত । এভাবে মানুষ এক দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য দ্রব্য বিনিময় করে অভাব পূরণ করার ব্যবস্থাকে সরাসরি পণ্য বিনিময় প্রথা (Barter System) বলে । আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে কোনো কোনো এলাকায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো এ প্রথার প্রচলন দেখা যায় । তবে এ প্রথায় লেনদেন করতে গিয়ে মানুষকে নানা অসুবিধায় পড়তে হতো (যেমন- দ্রব্য বিভাজনে অসুবিধা ও পাবস্পরিক অভাবের অমিল ইত্যাদি) । এসব অসুবিধা দূর করতে অর্থের আবির্ভাব ঘটে । আধুনিক অর্থনীতিতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থ সর্বজনস্বীকৃত ও গৃহীত । অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম, দ্রব্য ও সেবার মূল্যের পরিমাপক এবং সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে ।
সুতরাং, সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত যে বস্তু মূল্যের পরিমাপক, দেনা-পাওনা মেটানোর উপায় হিসেবে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য, সঞ্চয়ের বাহন ও ঋণের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত, তাকে অর্থ বলে । বিভিন্ন দেশে অর্থ বিভিন্ন নামে পরিচিত । যেমন- বাংলাদেশে টাকা, ভারতে রুপি, আমেরিকায় ডলার এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশে ইউরো ।
অর্থের প্রকারভেদ-
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থের শ্রেণিবিভাগ করা যায় । নিচে তা আলোচনা করা হলো :
তৈরির উপকরণের দিক থেকে অর্থকে দুভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
১) ধাতব মুদ্রা ও
২) কাগজি নোট
ধাতব মুদ্ৰা
ধাতব খণ্ড দ্বারা তৈরি যে মুদ্রার মাধ্যমে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনের লেনদেন করে, তাকে ধাতব মুদ্রা বলে । বাংলাদেশে ৫ টাকা, ২ টাকা, ১ টাকা, ৫০ পয়সা ইত্যাদি ধাতব মুদ্রা আছে ।ধাতব মুদ্রাকে বস্তুগত মূল্যমানের দিক থেকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় । যথা : (ক) প্ৰামাণিক মুদ্ৰা (খ) প্রতীক মুদ্রা । প্রামাণিক মুদ্রা বলতে বোঝায় যে মুদ্রা গলানোর মাধ্যমে ধাতু হিসেবে বিক্রি করলে দৃশ্যমান মূল্যের সমপরিমাণ মূল্য পাওয়া যায় । আর প্রতীক মুদ্রা বলতে বোঝায়, যে মুদ্রার ধাতব মূল্য তার দৃশ্যমান মূল্যের চেয়ে কম থাকে । সাধারণত ধাতব মুদ্রা সরকার কর্তৃক প্রচলিত হয় ।
কাগজি নোট
যেসব মুদ্রা কাগজ দ্বারা তৈরি করা হয়, তাকে কাগজি মুদ্রা বা নোট বলে । নোটের উপর লিখিত মূল্যই তার মূল্যের নির্দেশক,যা সাধারণত নোটের কাগজটির মূল্য অপেক্ষা অধিক হয় । প্রায় সকল দেশেই কাগজি মুদ্রা বা নোট সরকারি নির্দেশে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রচলিত হয় । বাংলাদেশের কাগজি মুদ্রা হলো ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট ।
কাগজি মুদ্রাকে দুভাগে ভাগ করা যায় । যথা- (ক) রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা (খ) রূপান্তর অযোগ্য মুদ্ৰা ।
রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা বলতে বুঝায় যে কাগজি নোটের পরিবর্তে চাওয়ামাত্র সরকার সমমূল্যের দেশীয় মুদ্রা দিতে বাধ্য থাকে । বাংলাদেশে রূপান্তরযোগ্য নোট হলো- ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট। আর রূপান্তর অযোগ্য মুদ্রা বলতে বোঝায় যে কাগজি নোটের পরিবর্তে সরকারের কাছ থেকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা, রুপা পাওয়া যায় না । বাংলাদেশে রূপান্তর অযোগ্য কাগজি নোট হলো ১ টাকা ও ২ টাকার নোট । গ্রহণের বাধ্যবাধকতার দিক থেকে অর্থকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় । যথা : ১) বিহিত অর্থ ২) ব্যাংক হিসাব বা ব্যাংক সৃষ্ট অর্থ।
বিহিত অর্থ
যে অর্থ সরকারি আইন দ্বারা প্রচলিত, তাকে বিহিত অর্থ বলে । আমাদের দেশের বিহিত অর্থ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রচলিত ধাতব মুদ্রা ও কাগজি নোট নিয়ে গঠিত । বিহিত অর্থকে দুভাগে ভাগ করা যায়- ক) অসীম বিহিত অর্থ খ) সসীম বিহিত অর্থ । অসীম বিহিত অর্থ বলতে বোঝায়, যে বিহিত অর্থ দ্বারা আইনগত যেকোনো পরিমাণ লেনদেন করা যায় এবং দেনা-পাওনা পরিশোধ করলে পাওনাদার তা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে । আমাদের দেশের অসীম বিহিত অর্থ হলো- ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট । সসীম বিহিত অর্থ বলতে বোঝায়, যে বিহিত অর্থ দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত লেনদেন করা যায়, আইনগতভাবে জনগণকে অধিক গ্রহণে বাধ্য করা যায় না এবং জনগণ তার ইচ্ছা অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে পারে । আমাদের দেশের সসীম বিহিত অর্থ হলো- ৫০ পয়সা, ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্ৰা ।
ব্যাংকসৃষ্ট অর্থ
বর্তমানে ব্যবসায়িক লেনদেন ও দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে ব্যাংক হিসাব বা ব্যাংক সৃষ্ট অর্থ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে মানুষ গ্রহণ করে । তবে তা গ্রহণ করতে কাউকে বাধ্য করা যায় না । বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত সৃষ্টি করে বা ঋণ প্রদান করে অর্থ সৃষ্টি
করতে পারে।
VISA
direct H
VISA
ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড
ব্যাংকসৃষ্ট আমানত বা ওভার ড্রাফটের বিপরীতে চেক কেটে লেনদেন করা যায়। ব্যাংকসৃষ্ট আমানত বা হিসাবকে অর্থ হিসেবে গণ্য করা চলে। আমাদের দেশে ব্যাংকসৃষ্ট অর্থ হলো- চলতি হিসাবে আমানত এবং সঞ্চয়ী হিসাবে আমানত, যা চেকের দ্বারা তোলা যায়। এ ছাড়া ব্যাংক কর্তৃক প্রচলিত ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
আধুনিক উৎপাদনব্যবস্থায় এবং সমাজজীবনে অর্থ নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে।
কবি অর্থের কার্যাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
যাহা করে বিনিময় ও মূল্য পরিমাপ অর্থ বলি গণ্য তারে করে সর্বজন ।
ঋণ পরিশোধ আর সঞ্চয় সাধন
ইংরেজি কবিতার দুটি চরণে অর্থের কার্যাবলি প্রকাশ পায় -
"Money is a matter of functions four; A medium, a measure, a standard, a store. "
অর্থাৎ, অর্থের কাজ হলো চারটি । যথা : বিনিময়ের মাধ্যম, মূল্যের পরিমাপক, লেনদেনের বাহন ও সঞ্চয়ের বাহন। নিচে অর্থের প্রধান চারটি কাজের বিবরণ দেওয়া হলো :
বিনিময়ের মাধ্যম
অর্থ সবার নিকট গ্রহণযোগ্য বলে অর্থের বিনিময়ে লেনদেন সম্পন্ন হয় । বিক্রেতা কোনো দ্রব্যের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে আবার ক্রেতাও অর্থের বিনিময়ে দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করে । এভাবে অর্থের দ্বারা যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় করা যায় । ফলে লেনদেন সহজ ও গতিশীল হয় । তাই বলা যায়, অর্থ বিনিময়ের সবচেয়ে সহজ ও সুবিধাজনক মাধ্যম ।
মূল্যের পরিমাপক
মিটার যেমন দৈর্ঘ্যের, কিলোগ্রাম যেমন ওজনের পরিমাপক, ঠিক তেমনি অর্থ পণ্য ও সেবার মূল্যের পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয় । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আমির একটি বই ক্রয় করে ৫০ টাকা দিয়ে । এক্ষেত্রে ৫০ টাকা হলো উক্ত বইটির মূল্যের পরিমাপক । অর্থের সাহায্যে আমরা সহজেই পণ্য ও সেবার মূল্য পরিমাপ করে অতীত ও ভবিষ্যতের পণ্য ও সেবার মূল্য সম্বন্ধে তুলনামূলক আলোচনা করতে পারি ।
সঞ্চয়ের বাহন
অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী পচনশীল বলে দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে সঞ্চয় করা সম্ভব নয় । তাছাড়া সেবা জীবন্ত উপকরণ তাই শ্রম ও সেবা সঞ্চয় করে রাখা যায় না । কিন্তু অর্থ দ্বারা সবকিছু বিনিময় করা যায় বলে এরূপ দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য অর্থের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা সম্ভব । বর্তমানে মানুষ তার উৎপাদিত আয় থেকে ভোগ ব্যয় বাদ দিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা অর্থের মাধ্যমে সঞ্চয় করতে পারে, কারণ অর্থের মাধ্যমে সঞ্চয় অনেক বেশি নিরাপদ ও তুলনামূলকভাবে স্থায়ী ।
স্থগিত লেনদেনের বাহন
স্থগিত লেনদেন বলতে ভবিষ্যৎ দেনা-পাওনাকে নির্দেশ করে । এসব দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ অর্থের মাধ্যমেই করা হয় । অর্থের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ সহজ এবং ঐ ঋণ পরিশোধ করাও সুবিধাজনক । ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে চলতে পারে, বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ব্যবসায়িক লেনদেন চেক, ব্যাংক ড্রাফট, বিনিময় বিল প্রভৃতিও ঋণপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় । ব্যাংকে আমানত হিসেবে রক্ষিত নগদ অর্থের ভিত্তিতেই ব্যাংক এসব ঋণপত্র প্রচলন করে । তাই অর্থকে ঋণের স্থগিত লেনদেনের বাহন হিসেবে গণ্য করা হয় ।
উপরিউক্ত কার্যাবলি ছাড়াও অর্থমূল্য স্থানান্তরের বাহন, তারল্যের মান ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে কাজ করে । অর্থের এই কাজগুলো পৃথক নয়, এদের একটি অপরটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে । তাই বলা হয়, অর্থের সকল কাজের মাধ্যমে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়েছে ।
যে ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে, তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন। এ ব্যাংক আমানতকারীর জমাকৃত অর্থের উপর কম হারে সুদ দেয়। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে সুদ আদায় করে। উভয় সুদের পার্থক্যই হলো ব্যাংকের মুনাফা। এ ব্যাংক জমাদানকারীকে তার জমাকৃত অর্থ চাওয়ামাত্র ফেরত দিতে বাধ্য থাকে বলে ব্যাংক তার তহবিল থেকে স্বল্পকালের জন্য ঋণ প্রদান করে। তাই এ ব্যাংককে স্বল্পমেয়াদী ঋণের ব্যবসায়ি বলে ।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হলো: সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ইত্যাদি ।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবযে ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে, তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন। এ ব্যাংক আমানতকারীর জমাকৃত অর্থের উপর কম হারে সুদ দেয়। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে সুদ আদায় করে। উভয় সুদের পার্থক্যই হলো ব্যাংকের মুনাফা। এ ব্যাংক জমাদানকারীকে তার জমাকৃত অর্থ চাওয়ামাত্র ফেরত দিতে বাধ্য থাকে বলে ব্যাংক তার তহবিল থেকে স্বল্পকালের জন্য ঋণ প্রদান করে। তাই এ ব্যাংককে স্বল্পমেয়াদী ঋণের ব্যবসায়ি বলে ।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হলো: সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ইত্যাদি ।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলি
আধুনিককালে বাণিজ্যিক ব্যাংক বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে । নিম্নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. আমানত গ্রহণ
বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আমানত সংগ্রহ করা। বাণিজ্যিক ব্যাংক তিন ধরনের আমানত গ্রহণ করে । যথা- (ক) চলতি আমানত, (খ) সঞ্চয়ী আমানত, (প) স্থায়ী আমানত ।
(ক) চলতি আমানত : চলতি আমানতের অর্থ আমানতকারী যেকোনো সময় ওঠাতে পারেন। এজন্য এ আমানতের উপর কোনো সুদ প্রদান করা হয় না ।
আধুনিককালে বাণিজ্যিক ব্যাংক বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে । নিম্নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. আমানত গ্রহণ
বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আমানত সংগ্রহ করা। বাণিজ্যিক ব্যাংক তিন ধরনের আমানত গ্রহণ করে । যথা- (ক) চলতি আমানত, (খ) সঞ্চয়ী আমানত, (প) স্থায়ী আমানত ।
(ক) চলতি আমানত : চলতি আমানতের অর্থ আমানতকারী যেকোনো সময় ওঠাতে পারেন। এজন্য এ আমানতের উপর কোনো সুদ প্রদান করা হয় না ।
(খ) সঞ্চয়ী আমানত : সঞ্চয়ী আমানতের অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময় মেয়াদে সাধারণত সপ্তাহে দুবার ওঠানো যায় । এই আমানতের উপর ব্যাংক কিছু সুদ দেয় ।
(গ) স্থায়ী আমানত : এ আমানত নিৰ্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা হয়। যেমন- ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর, ৩ বছর, ৫ বছর ইত্যাদি। ব্যাংক এ ধরনের আমানতের উপর অধিক হারে সুদ প্রদান করে থাকে । এ আমানতের অর্থ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেও তোলা যায় । এক্ষেত্রে কিছু বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হয়।
২. ঋণ দান করা
বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ আমানতকারীর চাহিদা মেটানোর জন্য গচ্ছিত রেখে বাকি অর্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ঋণ প্রদান করে । উপযুক্ত জামানত ও বন্ধকির যেমন- মূল্যবান ধাতু, ধাতব দ্রব্য, সরকারি ও দেশি-বিদেশি ঋণপত্র, স্থায়ী সম্পদ ইত্যাদি এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ প্রদান করে । আমাদের দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক গৃহনির্মাণ, মৎস্য চাষ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঋণ দেয় ৷
৩. বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি
বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংক সহজ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে চেক, ব্যাংক ড্রাফট, ই-পেমেন্ট, হুন্ডি ও ভ্রমণকারীর চেক ইত্যাদি সৃষ্টি করে । বিনিময় মাধ্যমগুলোর মধ্যে ব্যাংকের ইস্যুকৃত চেক বহুল ব্যবহৃত হয় । উন্নত দেশে অধিকাংশ লেনদেনই চেকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে ।
৪. দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা
বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যের সহায়তায় ব্যবসায়ীদের অর্থ যোগান দেওয়ার পাশাপাশি পরামর্শও দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের বিনিময় বিলে স্বীকৃতি প্রদান, বিল বাট্টাকরণ, আমদানি ও রপ্তানিকারককে ঋণ প্রদান, মেইল ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে দ্রব্য আদান-প্রদান, বৈদেশিক মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি হয় । এসব কার্য সম্পাদন করে বাণিজ্যিক ব্যাংক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে আমানত হিসেবে গ্রহণ করে । তা থেকে ব্যাংকসমূহ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা নির্মাণ ও সম্প্রসারণে ঋণ সহায়তা দান করে থাকে । শিল্পের কাঁচামাল এবং উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ প্রদান করে । এছাড়া নতুন নতুন কোম্পানির শেয়ার কিনে দেশে কলকারখানা গড়তে সহায়তা করে ।
বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়তা করে । বর্তমানে এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রিক্সা ও ভ্যান ক্রয়, মুদির দোকান খোলা, চাল-ডাল-গম ভাঙানোর মিল স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জামানতের বিপরীতে ঋণ প্রদান শুরু করেছে । এর ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে বলে আশা করা যায় ।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
কৃষি খাতের গতিশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি স্বনির্ভরতা অর্জন এবং সার্বিক কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় । স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৭৩ রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে পাকিস্তান কৃষি ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পদ নিয়ে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান । নিম্নে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি ও কৃষির সাথে জড়িত খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে ।
ক. আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র । তাই কৃষকের ছোটখাটো প্রয়োজন মেটানোর জন্য (যেমন- সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ প্রভৃতি ক্রয় এবং জমি চাষ, ফসল নিড়ানো, ফসল কাটা, মাড়াই ইত্যাদি কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য) এ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদান করে । এ ঋণ সাধারণত ১৮ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
খ. জমি সমতল করা, অগভীর নলকূপ স্থাপন, চাষের জন্য গবাদিপশু এবং হালকা কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করা প্রভৃতি কাজের জন্য এ ব্যাংক কৃষককে মধ্যম মেয়াদি ঋণ প্রদান করে । এ ঋণ সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
গ. জমি ও ভারী যন্ত্রপাতি (যেমন- ট্রাক্টর, হারভেস্টর ইত্যাদি) ক্রয়, গভীর নলকূপ স্থাপন, গুদামঘর নির্মাণ, হিমাগার নির্মাণ, পানি সেচের উদ্দেশ্যে খাল খনন, চা বাগানের উন্নয়ন এসব কাজের জন্য কৃষি ব্যাংক কৃষককে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে । এ ঋণ ৫ বছর থেকে ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
এ ব্যাংক কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে । এ ব্যাংক হাঁস-মুরগি ও পশুপালন, মৌমাছি ও গুটিপোকার চাষ, মৎস্য খামার তৈরি প্রভৃতি কাজের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে, যা নিয়ে আমাদের বেকার যুবকরা তাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পায় ।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড
গত ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে সরকার ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে Vendors Agreement স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা নামক প্রতিষ্ঠান দুটি একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড গঠিত হয় । বিলুপ্ত প্রতিষ্ঠান দুটির দায়, সম্পদ ও জনবল নতুন প্রতিষ্ঠানের নিকট অর্পিত হয়েছে । নিম্নে এ ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
এ ব্যাংক সাধারণত আমাদের দেশের সাথে সম্পৃক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ঋণ প্রদান করে, যেমন- পাটশিল্প, চামড়াশিল্প, চিনিশিল্প ও সারশিল্প ইত্যাদি । পল্লি এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে অগ্রাধিকার প্রদান করছে, যা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে সহায়ক ।
এই ব্যাংক সরকারি ও বেসরকারি খাতে নতুন শিল্প নির্মাণ, পুরাতন শিল্প সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। এই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা সর্বোচ্চ ২০ বছর । শিল্প কারখানার প্রয়োজনে এ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণও প্রদান করে । উদ্যোক্তাকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ প্রদান এবং শিল্পায়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকার গবেষণা, পরিসংখ্যান ও তথ্য সংগ্রহ করে থাকে ।
স্বনির্ভরতা অর্জন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে মেয়াদি ঋণ প্রদান করছে। নারীকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করছে। বেসরকারিভাবে শিল্প উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা দান ও শিল্প কার্যক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করে ।
কাজ : উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের ভূমিকা লিখ ।
গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামের অতি স্বল্প জমির মালিক, ভূমিহীন এবং অন্যান্য অতি দরিদ্র নারী-পুরুষের মাঝে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো গ্রামীণ ব্যাংক । জনসাধারণকে এ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে । ১৯৮৩ সালে একটি বিশেষ অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করে । এটি সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক নয়। আইনত এর প্রধান মালিক হচ্ছেন এর দরিদ্র ত্রিশ লক্ষ গ্রাহকবৃন্দ। নিম্নে এ ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ব্যাংক-ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করে সমগ্র ব্যাংক-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মুদ্রাবাজারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। এটি সরকারের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে থেকে নোট ও মুদ্রা প্রচলন, ঋণ নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার মান সংরক্ষণ, মুদ্রাবাজার সংগঠন ও পরিচালনা এবং সরকারের আর্থিক উপদেষ্টা ও ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তাই এর প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা সর্বোচ্চকরণ নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, উন্নয়ন ও জনকল্যাণ সর্বোচ্চকরণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি স্বাধীন দেশেই একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে। যেমন : বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এবং ইংল্যান্ডের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ইত্যাদি ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যাবলি
প্রত্যেক দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ও মুদ্রাবাজারের অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। নিম্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি আলোচনা করা হলো-
১ নোট ও মুদ্রা প্রচলন
কোনো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নোট ও মুদ্রা প্রচলন করে। এ ব্যাংক দেশের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নোট প্রচলন করে। অতীতে দেশে নোট প্রচলনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আইন অনুযায়ী স্বর্ণ, রৌপ্য বা বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখতে হতো । বর্তমানে দেশে অর্থের যোগান ও তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির উপর নির্ভরশীল ।২. সরকারের ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব পাওনা সরকারের হিসাবে জমা করে এবং সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে অর্থ প্রদান করে। আর্থিক সংকটের সময় সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে । সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযোগ রক্ষা করে । সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নীতি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৩. অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে নতুন ব্যাংক ও শাখা প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি প্রদান করে । তার অধীন তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান করে। আইন বা প্ৰচলিত প্রথা অনুযায়ী তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহকে তাদের আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত রাখতে হয় । এ গচ্ছিত তহবিল হতে প্রয়োজনে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহ ঋণ গ্রহণ করতে পারে । আমাদের দেশের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে তাদের চলতি ও স্থায়ী আমানতের শতকরা পাঁচ ভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয় ।
৪. ঋণ নিয়ন্ত্রণ
কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঋণের স্বল্পতা ও আধিক্য উভয়ই ক্ষতিকর । কেননা বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ যে ঋণ দেয় তা মোট অর্থের যোগানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা দামস্তর এবং অর্থের মূল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে । ঋণের আধিক্যের জন্য দেশে মুদ্রাস্ফীতি হয় । ঋণের স্বল্পতার জন্য দেশে মুদ্রা সংকোচন হয়। এসব অসুবিধা যেন দেখা না দেয় সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের ঋণদান ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রয়োগ করে ।
৫. সর্বশেষ ঋণদাতা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহ কখনও আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে অন্য কোনো উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয় । তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটাপন্ন ব্যাংকসমূহের নির্দিষ্ট জামানতের বিপরীতে ও বিভিন্ন ঋণপত্রের বিপরীতে ঋণ প্রদান করে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয় ।
৬. বিনিময় হার নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ
বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য আনয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশীয় মুদ্রার সাথে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে । যেমন, টাকার বিপরীতে ডলার, ইউরো ইত্যাদির বিনিময় হার নির্ধারণ। ব্যবসায় বাণিজ্যের সুবিধার জন্য এ ব্যাংক সরকারের পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করে অর্থের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখে।৭. নিকাশ ঘর দৈনন্দিন ব্যবসায় বাণিজ্য ও লেনদেনের ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে চেক, ব্যাংক ড্রাফট ও পেঅর্ডার আদান- প্রদান হয়। ফলে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে পাওনাদার বা দেনাদার হয়। কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে কত পাওনা বা কত দেনা তার সর্বশেষ হিসাব সংরক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক । বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের যে অর্থ বা তহবিল কেন্দ্ৰীয় ব্যাংকে জমা থাকে, তা থেকে এরকম দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি করে। এভাবে এ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের চেক, ব্যাংক ড্রাফট ও পে-অর্ডারের নিকাশঘর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
স্বয়ংক্রিয় নিকাশঘর
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করে-
তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের নিয়োজিত জনশক্তির মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে । (খ) অধিভুক্ত সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা সময়ান্তে যাচাই করে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে ।
(গ) জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা করে ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন নিয়মকানুন তৈরি ও বাস্তবায়ন করে ।
(ঘ) দেশে-বিদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের শাখা স্থাপনে সহায়তা করে ।
(ঙ) দেশবাসীর অবগতির জন্য এবং সরকারের আর্থিক নীতি প্রণয়নের সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যাবলির তথ্য সংগ্রহ ও সংকলন প্রকাশ করে এবং গবেষণার কাজ পরিচালনা করে ।
(চ) অর্থনীতির বিভিন্ন খাত, যেমন- কৃষি, শিল্প, সেবা (ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য) খাতের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে ।
উপরিউক্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।
আমাদের দেশের মুদ্রাব্যবস্থার তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে এবং সরকারের ব্যাংক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর জনসাধারণের আমানত গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ। অন্যদিকে বিশেষ খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে বিশেষায়িত ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ।
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যাংকের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম বাংলাদেশ ব্যাংক । স্বাধীনতা লাভের পর দেশের ব্যাংক ও মুদ্রাব্যবস্থায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির “বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২” -এর বলে বাংলাদেশে অবস্থিত সাবেক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সকল সম্পদ ও দায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় । অর্থ ও ঋণব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে স্থিতিশীল মুল্যস্তর বজায় রাখার মাধ্যমে দেশের কৃষি উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও আত্মকর্মসংস্থান তথা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জনগণের সামগ্রিক কল্যাপসাধনে এ ব্যাংক নিম্নোক্তভাবে ভূমিকা পালন করে :
দেশের কৃষি খাতে প্রয়োজনমাফিক কৃষিঋণ সরবরাহে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদারভাবে ঋণ তহবিল প্রদান করে । এ ছাড়া কৃষি উন্নয়নের জন্য গবেষণা পরিচালনা ও কৃষি পরিসংখ্যান তৈরি করে এ ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে ।
দেশের দ্রুত শিল্পায়নের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক শিল্প মূলধন সরবরাহকারী বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ তহবিল সরবরাহ করে । শিল্প উদ্যোক্তা শ্রেণি-বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণ ঋণ সহায়তা করে থাকে । বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্রের বিনিময়ে ঋণ প্রদান, নতুন ব্যাংক স্থাপন এবং অনুন্নত এলাকায় বাণিজ্যিক
ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের নতুন শাখা স্থাপন করে, ঋণের যোগান নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি করে । ক্ষেত্রবিশেষে এ ব্যাংক নিজ উদ্যোগে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ।
কাজ : অর্থব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক- ব্যাখ্যা কর ।
বাণিজ্যিক ব্যাংক
দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন ও শিল্পায়নে অর্থসংস্থানের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশীদার বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারি ও বেসরকারি এ দুভাগে বিভক্ত করা যায় । নিম্নে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
কৃষি ও শিল্প খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক
বাংলাদেশে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত । ফলে কৃষি উন্নয়নের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে। এ দেশের অধিকাংশ কৃষক গরিব। তাই তাদের কৃষিকাজ পরিচালনার জন্য দরকার পর্যাপ্ত কৃষিঋণের। বর্তমানে কৃষি উন্নয়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে সরকার ঘোষিত কৃষি ঋণদান কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে । বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ক্রয়, পানি সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন এবং কুটির শিল্প স্থাপনের জন্য বিভিন্ন মেয়াদি ঋণ প্রদান কর্মসূচি পরিচালনা করে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে দেশের কৃষক মাত্র ১০ টাকা জমা রেখে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ পাচ্ছে । এতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সকল কৃষকের ডাটা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে ।
বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে আমানত হিসেবে গ্রহণ করে । তা থেকে ব্যাংকসমূহ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পকারখানা নির্মাণ ও সম্প্রসারণে ঋণ সহায়তা দান করে থাকে । শিল্পের কাঁচামাল এবং উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ প্রদান করে । এছাড়া নতুন নতুন কোম্পানির শেয়ার কিনে দেশে কলকারখানা গড়তে সহায়তা করে ।
বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়তা করে । বর্তমানে এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রিক্সা ও ভ্যান ক্রয়, মুদির দোকান খোলা, চাল-ডাল-গম ভাঙানোর মিল স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জামানতের বিপরীতে ঋণ প্রদান শুরু করেছে । এর ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে বলে আশা করা যায় ।
কাজ : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশীদার বাণিজ্যিক ব্যাংক- ব্যাখ্যা কর ।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
কৃষি খাতের গতিশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি স্বনির্ভরতা অর্জন এবং সার্বিক কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় । স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৭৩ রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে পাকিস্তান কৃষি ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পদ নিয়ে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান । নিম্নে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি ও কৃষির সাথে জড়িত খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে ।
ক. আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র । তাই কৃষকের ছোটখাটো প্রয়োজন মেটানোর জন্য (যেমন- সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ প্রভৃতি ক্রয় এবং জমি চাষ, ফসল নিড়ানো, ফসল কাটা, মাড়াই ইত্যাদি কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য) এ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদান করে । এ ঋণ সাধারণত ১৮ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
খ. জমি সমতল করা, অগভীর নলকূপ স্থাপন, চাষের জন্য গবাদিপশু এবং হালকা কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করা প্রভৃতি কাজের জন্য এ ব্যাংক কৃষককে মধ্যম মেয়াদি ঋণ প্রদান করে । এ ঋণ সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
গ. জমি ও ভারী যন্ত্রপাতি (যেমন- ট্রাক্টর, হারভেস্টর ইত্যাদি) ক্রয়, গভীর নলকূপ স্থাপন, গুদামঘর নির্মাণ, হিমাগার নির্মাণ, পানি সেচের উদ্দেশ্যে খাল খনন, চা বাগানের উন্নয়ন এসব কাজের জন্য কৃষি ব্যাংক কৃষককে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে । এ ঋণ ৫ বছর থেকে ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় ।
এ ব্যাংক কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে । এ ব্যাংক হাঁস-মুরগি ও পশুপালন, মৌমাছি ও গুটিপোকার চাষ, মৎস্য খামার তৈরি প্রভৃতি কাজের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে, যা নিয়ে আমাদের বেকার যুবকরা তাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পায় ।
কাজ : বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কৃষিঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়ন সম্ভব-ব্যাখ্যা কর ।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড
গত ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে সরকার ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে Vendors Agreement স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা নামক প্রতিষ্ঠান দুটি একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড গঠিত হয় । বিলুপ্ত প্রতিষ্ঠান দুটির দায়, সম্পদ ও জনবল নতুন প্রতিষ্ঠানের নিকট অর্পিত হয়েছে । নিম্নে এ ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
এ ব্যাংক সাধারণত আমাদের দেশের সাথে সম্পৃক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ঋণ প্রদান করে, যেমন- পাটশিল্প, চামড়াশিল্প, চিনিশিল্প ও সারশিল্প ইত্যাদি । পল্লি এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে অগ্রাধিকার প্রদান করছে, যা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে সহায়ক ।
এই ব্যাংক সরকারি ও বেসরকারি খাতে নতুন শিল্প নির্মাণ, পুরাতন শিল্প সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। এই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা সর্বোচ্চ ২০ বছর । শিল্প কারখানার প্রয়োজনে এ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণও প্রদান করে । উদ্যোক্তাকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ প্রদান এবং শিল্পায়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকার গবেষণা, পরিসংখ্যান ও তথ্য সংগ্রহ করে থাকে ।
স্বনির্ভরতা অর্জন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে মেয়াদি ঋণ প্রদান করছে। নারীকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করছে। বেসরকারিভাবে শিল্প উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা দান ও শিল্প কার্যক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করে ।
কাজ : উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের ভূমিকা লিখ ।
গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামের অতি স্বল্প জমির মালিক, ভূমিহীন এবং অন্যান্য অতি দরিদ্র নারী-পুরুষের মাঝে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো গ্রামীণ ব্যাংক । জনসাধারণকে এ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে । ১৯৮৩ সালে একটি বিশেষ অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করে । এটি সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক নয়। আইনত এর প্রধান মালিক হচ্ছেন এর দরিদ্র ত্রিশ লক্ষ গ্রাহকবৃন্দ। নিম্নে এ ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
এ ব্যাংক গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদেরকে সহজ শর্তে ও জামানত ছাড়া ঋণ প্রদান করে । কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য এ ব্যাংক শাকসবজি চাষ, গাভী পালন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন ও জমি চাষাবাদ ইত্যাদি খাতে ঋণ প্রদান করে । এ ব্যাংক পর্যাপ্ত ঋণ প্রদান করায় কৃষককে গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ও চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় না ।
দেশের অবহেলিত জনসাধারণকে অকৃষি খাতে সম্পৃক্ত করার জন্য গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে (যেমন- বাঁশ ও বেতের কাজ, বিড়ি তৈরি, সাবান তৈরি, কাপড় তৈরি ও মিষ্টি তৈরি) ঋণ প্রদানসহ উপকরণ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে। গ্রামীণ ফোনের কারিগরি সহায়তায় গ্রামের সাধারণ জনগণের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার জন্য পল্লিফোন চালু করে ।
সুবিধাবঞ্চিত বেকার জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় সংঘবদ্ধ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পরিচালিত ব্যাংক হলো গ্রামীণ ব্যাংক। এ ব্যাংক ভিক্ষুককে সুদবিহীন ঋণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করে। নারীকে কর্মে উদ্বুদ্ধকরণ ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে এ ব্যাংক সহায়তা করে। দরিদ্র অসহায় নারীদের ঋণ হিসেবে পল্লিফোন প্রদান করা হয় । এর আয় থেকে ঋণ পরিশোধ করে নারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। প্রতিবছর এর লভ্যাংশ থেকে দরিদ্র গ্রাহক মালিকদের ডিভিডেন্ডও (Dividend) প্রদান করা হয়।
সমবায় ব্যাংক
সমবায়ের নীতিমালার ভিত্তিতে গঠিত এবং পরিচালিত ব্যাংককে সমবায় ব্যাংক বলে। পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করাই সমবায় ব্যাংকের উদ্দেশ্য। সরকার ও দেশের সমবায়ীর যৌথ মালিকানায় পরিচালিত বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির শেয়ারের ৮৬% মালিক সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ১৪% সরকারের মালিকানায় । নিম্নে সমবায় ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
এ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমবায় সমিতির সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী কৃষিঋণ প্রদান করে । ঋণ প্রদানের খাতগুলো হলো- কৃষি, ভূমি উন্নয়ন, আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষ, শীতকালীন ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন, বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ যেমন- বীজ, সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র ও ট্রাক্টর ইত্যাদি। কৃষিঋণের মেয়াদ তিন ধরনের হয়, যেমন : স্বল্পকালীন - ৬ মাসের জন্য, মধ্যম মেয়াদি - ২ বছরের জন্য এবং দীর্ঘকালীন- ৫ বছরের জন্য প্রদান করে । সমবায়ের ভিত্তিতে সংগঠিত কৃষিভিত্তিক শিল্পসমূহে এবং নির্মাণশিল্পে এ ব্যাংক অর্থায়ন করে ।
এ ব্যাংক গ্রামীণ যুব ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গ্রহণ করে । সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্পের অংশীদার সমবায় ব্যাংক । এছাড়া দেশের আত্মকর্মসংস্থানের বিভিন্ন উপায়, যেমন- মাছ চাষ, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন এবং উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণে সমবায় ব্যাংক অর্থায়ন করে থাকে । যার ফলে দেশের বেকারত্ব লাঘবের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে এ ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।
Read more